লেখকঃ প্রিন্স মাহমুদ, সানজাক-ই উসমান
আপনি আমি মাংসের সঙ্গে যে গরম মসলার স্বাদ পাই, সেই গরম মসলার দাম এক সময় স্বর্ণের চেয়ে বেশি ছিল। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। সোনার চেয়ে দামি ছিল লবঙ্গ, দারুচিনি, গোলমরিচ, জায়ফল, হলুদ, আদা আর এলাচি। ভারতীয় বণিকরা কেরালা, মালাবার, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা, আচেহ, বালি, জাভা, তিমুর, নিউগিনি থেকে মসলা জাহাজে ভাসিয়ে নিয়ে যেত মালাক্কা প্রণালি হয়ে উপমহাদেশের মূল ভূখণ্ড পর্যন্ত।
সেখান থেকে আরব বণিকেরা মসলার কাফেলা নিয়ে রওনা হতো পশ্চিমে। জাহাজগুলো চলাচল করত শ্রীলঙ্কা, গুজরাট, করাচি, হরমুজ প্রণালি হয়ে বাবেল মান্দেব প্রণালি হয়ে এডেন, আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে সিরিয়া, লেবানন, আনাতোলিয়া হয়ে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে। পূর্বে কনস্ট্যান্টিনোপল, পশ্চিমে রোম। আরেকটা বাণিজ্যপথ আছে, সেটা আরও বিখ্যাত।
পড়াশোনা করেছেন কিন্তু সিল্করোডের নাম শোনেননি, এমন মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। সিল্করোড ছিল ভারত-চীন থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত চলে যাওয়া বাণিজ্যপথ।
প্রাচীনকালে এই পথ নিয়ন্ত্রণ করতেন রোমান সম্রাট। ইসলাম তার অভ্যুদয়ের ত্রিশ বছরের মধ্যে সিল্ক রোডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে জলে-স্থলে মসলার ব্যবসাটা চলে যায় আরব মুসলিমদের হাতে। সম্ভবত আলিফ লায়লার সিন্দাবাদ এই মসলা ব্যবসায়ীদেরই একজন ছিলেন।
মুহাম্মাদ আল ফাতিহ যখন কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করে নিলেন, তখন এই দুটো বাণিজ্যপথ সরাসরি ব্লকড হয়ে গেল। কনস্ট্যান্টিনোপল/ইসলামবুল থেকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা যেত সিল্করোডের প্রবেশপথ। আর অবশ্যই ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগরে প্রবেশের লাইসেন্সটাও ছিল কনস্ট্যান্টিনোপল/ইসলামবুলের মালিকের একচেটিয়া দখলে। ফলে মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে দুনিয়ার এক নম্বর ব্যবসাটা মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে চলে এলো।
সমুদ্রপথে মসলার বাণিজ্যের ওপর মুহাম্মাদ আল ফাতিহ উঁচুদরের ট্যাক্স বসিয়ে দিলেন। ফলে ইউরোপের রাজ-রাজড়ার ডাইনিং টেবিলে মসলার আমদানি কমে গেল।
মসলার দাম শেষে এত বাড়ল যে, এক পাউন্ড জায়ফল কিনতে তখন সাত সাতটা মোটাতাজা ষাঁড়ের প্রয়োজন হতো।
এই পরিমাণ দামে মসলা কেনা খুবই কঠিন হয়ে যেতে থাকল ইউরোপের মানুষের জন্য। ইউরোপের ব্যবসায়ীরা কড়া করে ধরলেন কিং-কুইন-মনার্কদের। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছিল না। মুহাম্মাদ আল ফাতিহর সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো সাহস না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তারা বিকল্প বাণিজ্যপথ বের করার কথা ভাবতে লাগলেন। সেই পথ বড়ো কঠিন পথ।
সমগ্র আফ্রিকার পশ্চিম-দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল ঘুরে গিয়ে ভারত মহাসাগরে পাল তোলার পথ। ইউরোপিয়ান সম্রাটদের স্পন্সরশিপে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে লাগলেন দুঃসাহসী নাবিকেরা। কলম্বাস, অ্যামেরিগো ভেসপুচি, ক্যাব্রালদের মতো বেপরোয়া নাবিকরা মসলার দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য জান বাজি রেখে বেরিয়ে পড়লেন। শুরু হলো দি এজ অফ ডিসকভারির। পরের তিনশো বছর ইউরোপের সিবোর্ড নেশনগুলো যুদ্ধ করেছে এই মসলার ব্যবসার একচেটিয়া দখল নিয়ে। ষোড়োশ শতাব্দীর অটোমান-পতুর্গিজ ওয়ার, অটোমান-ভেনেশিয়ান ওয়ার, স্প্যানিশ-পতুর্গিজ ওয়ারের মূল কারণ ছিল লবঙ্গ ব্যবসা নিয়ে বিবাদ। সেভেন্টিন্থ সেঞ্চুরিতে ব্রিটিশ-স্প্যানিশ ওয়ার, ডাচ-ব্রিটিশ ওয়ারের মূলে ছিল গোলমরিচের ব্যবসা।
গরম মসলার গরম, একটা সময় সোনার চেয়েও বেশি ছিল।
আধুনিক উপনিবেশবাদের জন্মদাতা যদি রেনেসাঁ হয়, তবে জননী অবশ্যই গরম মসলা।
সমাপ্ত.....